ভূমিকা:

ভূ-বৈচিত্রের বাংলাদেশ পাহাড়ী এলাকা সমূহের বিকাশমান আপদ ভূমি ধস। প্রাকৃতিক কারণের সাথে সাথে নানাবিধ বিষয় ভিত্তিক কারণ যথা সামাজিক, ভূমি ব্যবহার, আইনের শাসন ইত্যাদির উপস্থিতিও রয়েছে যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর দুর্যোগ ঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর দুর্যোগ ঝুঁকি হাসের অন্যতম সুপারিশ রুপে উল্লেখযোগ্য হল পাহাড় রক্ষাকারি কমিটি গঠন; পাহাড় রক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন; পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য দুর্যোগ সহনশীল এবং পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন কর্মকান্ডের নীতিমালা প্রণয়ন এবং সেই সাথে দুর্যোগ সহনশীল এবং পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন কর্মকান্ডের বাস্তবায়ন; পাহাড় সমূহকে নানাবিধ দুর্যোগের ভিত্তিতে ভূমি শ্রেণীকরণ; ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন তার বাস্তবায়ন; বন বিভাগ কর্তৃর্ক পাহাড়ে যথাযথ প্রজাতির বনায়ন কার্যক্রম গ্রহণ; অবৈধ পাহাড় কর্তন বন্ধকরন; পার্বত্য এলাকার সার্বিক পানি নিষ্কাশনে এবং পাহাড় উপযোগী নতুন পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণ এবং ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার আশু সংস্কার সাধন।

আরও উল্লেখ্য সুপারিশ সমূহের অন্যতম হল, পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন; পাহাড়ের ঢাল রক্ষার্থে দ্রুত পরিবেশ বান্ধব বৃক্ষরোপণ; পাহাড়ের ঢাল রক্ষা ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট গবেষণার সুযোগ সৃষ্টিকরণ; পাহাড় কাটার কুফল সম্পর্কে পাহাড়ী এলাকার জনগণকে সচেতন করণ। কাপ্তাই হ্রদের পানি প্রবাহ পরিমানের হালনাগাদ তথ্য সময়মত সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিতকরন, নিশ্চিতকরণ; ভূমিধস বা পাহাড়ধস সহ সকল দুর্যোগের পূর্বাভাস নিরুপন, সংক্রান্ত তথ্য সময় মত সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ প্রশাসনকে অবহিতকরণ এবং বিশেষ করে স্থানীয় জনসাধারণকে সময়মত অবহিতকরণ। দুর্যোগঝুঁকি মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের পর্যাপ্ত নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; অনুসন্ধান এবং উদ্ধারকার্যে পর্যাপ্ত এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করা; দুর্যোগকালে এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থাকরণ; ভূমিধস বা পাহাড়ধস মনিটরিং এবং ওয়ার্নিং সিস্টেম, Debris flow ওয়ার্নিং সিস্টেম এর ব্যবস্থা চালুকরণ বিশেষ প্রয়োজন।

উক্ত প্রেক্ষাপটে ভূমিধস জনিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাজ বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং সমরূপতা আনার লক্ষ্যে এই নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হল। এটি অনুসরণ করে স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো ভূমিধস রোধে প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে পারবে। পাশাপাশি কোন স্থানে ভূমিধস জনিত দুর্যোগ দেখা দিলে তা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে।

 

১. পাহাড় ধসের প্রেক্ষাপটঃ

ভূতাত্বিক ও ভৌগলিক পরিবেশের কারণে ভূমিধস হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাহাড়ধস ও ভূমিধসের বিভিন্ন প্রকার কারণ থাকতে পারে। পাহাড়ধসের কারণসমূহ সকল দেশে একইরকম নয়। বাংলাদেশের পাহাড়ের মাটির ধরণ চাষাবাদ উপযোগী অপরপক্ষে অন্যান্য দেশের পাহাড় পাথুরে মাটি হওয়ায় সেসকল স্থানে স্বাভাবিকভাবেই চাষাবাদ সম্ভব নয়। আমাদের এখানে পার্বত্য এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমান অনেক বেশি। তদুপরি স্বল্প আয়তনের এই ছোট দেশটিতে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর বাসস্থান। ঘনবসতিপূর্ন এ দেশের জনগণের খাদ্য উৎপাদন, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত জমি না থাকায় পাহাড়ী জমির উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। রাঙ্গামাটি জেলা শহরের পার্শ্ববর্তী পাহাড়গুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এটা এজন্য যে রাঙ্গামাটি ও এর নিকটবর্তী কাপ্তাই, ঘাগড়া, বড়ইছড়ি, রাজস্থলী, নানিয়ারচর এলাকাগুলোতেই সবচাইতে বেশী মানুষের বসবাস।

 

এসব এলাকাসমূহকে যুক্ত করে রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই (লেকের পাশ দিয়ে), রাঙ্গামাটি, ঘাগড়া-চট্টগ্রাম, ঘাগড়া-বড়ইছড়ি, ঘাগড়া-কাউখালী, রাঙ্গামাটি-মানিকছড়ি-খাগড়াছড়ি, বগাছড়ি-নানিয়ারচর সড়কগুলো তৈরী করা হয়েছে। এত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বসবাস, তাদের জন্য ঘরবাড়ী ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরী এবং চাষাবাদ, কাঠ আহরণজনিত কারণে এসব এলাকার পাহাড়গুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এ কারণেই একই পরিমান বৃষ্টিপাতের পরও রাঙ্গামাটি জেলার অন্যান্য এলাকার চেয়ে এ এলাকাসমূহেই পাহাড় ধ্বসের পরিমান অনেক বেশী। আবার এরকম নরম প্রকৃতির মাটিতে গড়া পাহাড়ের উপর দিয়ে রাস্তা-ঘাট, দালান-কোঠা বিভিন্ন স্থাপনা তৈরী করার সময় 'নদী শাসনের ন্যায় পাহাড় শাসনের' কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। পাহাড় কেটে যে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে তার নিচের মাটি এবং পাশে দাঁড়ানো পাহাড়ের অংশবিশেষও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

 

এসকল ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য প্রকৌশল এবং প্রযুক্তিগত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে প্রতি বছরই হয় পিচঢালা রাস্তাগুলো ধসে পড়ছে অথবা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়গুলো রাস্তার উপর ধসে পড়ছে। বাংলাদেমে নদীর উপর সেতু তৈরীর সময় সেতুর মূল অবকাঠামো তৈরীর সমান কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে তার চাইতে বেশী অর্থ বরাদ্দ করা হয়ে থাকে নদী শাসনে। অনুরুপভাবে উন্নত দেশগুলোতে শক্ত পাথুরে পাহাড়ী মাটিতে গড়ে তোলা রাস্তা এবং অন্যান্য স্থাপনাগুলো সুরক্ষিত করার জন্য প্রযুক্তি এবং প্রকৌশল ব্যবহার করে পাহাড় শাসন করা হয়েছে। আমাদের বৃহৎ অবকাঠামো কিংবা ক্ষুদ্র, মাঝারী আকৃতির স্থাপনা, ঘর-বাড়ি তৈরীতে মাটির দুর্বলতা সত্বেও পাহাড় শাসনের বিষয়টি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পাহাড় ধসের কারণ লিপিবদ্ধ করলে গুরুত্ব অনুসারে নিম্নেবর্ণিত কারণগুলো উঠে আসবেঃ

) দুর্বল মাটির গঠন।

) অতি বৃষ্টিপাত 

) চাষাবাদ।

) অপরিকল্পিত অবকাঠামো বসতি নির্মাণ।

) বৃক্ষ নিধন।

) উন্নত প্রযুক্তি প্রকৌশল ব্যবহার করে পাহাড় শাসন না করা।

 

পাহাড় ধসের প্রেক্ষিত আলোচনায় বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে পাহাড় ধসের সম্ভাব্য কারণের একটি তুলনামূলক চিত্র নিম্নে দেয়া হলোঃ 

ক্রমিক নং পাহাড় ধসের সম্ভাব্য কারণ

বাংলাদেশ

অন্যান্য দেশ মন্তব্য
১।  ভূতাত্বিক অবস্থা অর্থাৎ মাটি/পাথরের প্রকৃতি গঠন বেলে/বেলে দোঁআশ দুর্বল প্রকৃতির গঠন পাথরে/এটেল মজবুত প্রকৃতির  
২। অতি বৃষ্টিপাতহয়হয়/হয় নাবৃষ্টিপাতের ধরণ, তীব্রতা, সময় ও পরিমানের উপর নির্ভর করে
৩। চাষাবাদ অনেক বেশী চাষাবাদ হয় হয় না/নগণ্য  
৪। বৃক্ষ নিধন

হয়

অপেক্ষাকৃত কম/নিয়ন্ত্রিত 
৫। পাহাড় শাসন

হয় না

হয়

 
৬। অবকাঠামো ও বসতি নির্মাণ

হয়

হয় না

 
৭।

ভূমিকম্পের প্রভাব

হয়

হয় না

 
৮।

মনুষ্য সৃষ্ট কার্যক্রম

হয়

হয় না

 

 

তথ্যের বিষয়ের ধরণের ভিত্তিতে পাহাড়ধসের প্রেক্ষাপটের আলোচনা নিম্নোক্ত শিরোনামের আলোকে উল্লেখ করা হল-

 

 ১.১ প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটঃ

অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। উপরন্তু অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার রাঙ্গামাটীর জেলার মাটির ধারণ ক্ষমতা হ্রাস করেছে ফলে সামান্য বৃষ্টিপাতেই মাটি ধসে পড়ার ঘটনা ঘটছে।

 

১.২ সামাজিক প্রেক্ষাপটঃ

 সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোচনায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্যঃ

 ভূমি ব্যবহারঃ

পাহাড়ে অপরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণ ভূমিধসের অন্যতম প্রধান কারণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের সংখ্যা ২৮টি। সে সব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধ দখলদারদের দ্বারা নির্মিত হয়ে চলেছে বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ সুবিধাসহ বাড়ি যা সাধারণতঃ ছিন্নমূল পরিবারের নিকট আবাস স্থল হিসেবে যথেষ্ট আকর্ষণীয়। অবৈধ দখলদারদের এ দৌরাত্ম পাহাড়গুলোকে দুর্যোগ প্রবণ করে তুলছে। এছাড়াও অর্থ উপার্জনের উপায়গুলো কেবল কেন্দ্রের নিকটবর্তী স্থানে ঘনীভূত হয়ে থাকার কারনে দিন মজুর শ্রেণির লোকের সেখানে ক্রমাগত অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ । বসবাস বেড়েই চলেছে।

 

 অসাধু তৎপরতাঃ

 পাহাড়ধসের প্রেক্ষিত আলোচনায় সর্বাগ্রে যে সমস্যা আবির্ভূত হয় তা'হল সেখানের অসাধু তৎপরাতা। ভূমি দখল, অবৈধ বাসস্থান নির্মান, সড়ক বিভাগের ভূমির উপর ক্রমাগত অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, এবং একশ্রেনির অসাধু কর্মচারি কর্তৃক সড়ক বিভাগের ভূমি ভাড়া দেওয়া ও বিক্রি করার নীতিবহির্ভূত কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকা, পাহাড়ে মাদক ব্যবসাসহ নানান অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকান্ডের উপস্থিতি পাহাড়গুলোকে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ন করে তুলছে।

 

গভর্নেন্স সংক্রান্ত সমস্যাঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে এ দুর্যোগে সাড়াদানে, দুর্যোগ পুনরুদ্ধারে এবং পরবর্তী যে কোন দুর্যোগের সহনশীলতার আলোচনায় সর্বাগ্রে যে সমস্যা আবির্ভুত হয় তা হল সেখানের গভর্নেন্সের জটিলতা। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে।

 

 ২.০ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নির্দেশনাঃ

 পার্বত্য চট্টগ্রামে এ দুর্যোগে সাড়াদানে, দুর্যোগ পুনরুদ্ধারে এবং পরবর্তী যে কোন দুর্যোগের সহনশীলতার আলোচনায় সর্বাগ্রে যে সমস্যা আবির্ভূত হয় তা হল সেখানের গভর্নেন্সের জটিলতা এ সমস্যা থেকে উত্তরনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত উপায়গুলো সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং তাদের মাঝে যথাযথ সমন্বয় সাধন করা উচিত। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে ভূমিধসের পর এর কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখিত ২৮টি কারণ ও ৩৬ টি সুপারিশের পর্যালোচনা ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কাপ্তাই হ্রদের পানি প্রবাহ ও পরিমানের হালনাগাদ তথ্য সময়মত সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিতকরন প্রয়োজন। পাহাড়ে অবৈধ বসবাস পার্বত্য এলাকায় দুর্যোগ পুনরুদ্ধারে এবং দুর্যোগের সহনশীলতায় একটি উল্লেখযোগ্য অন্তরায় বিধায় পাহাড়ে অবৈধ বাসের কারণ অনুসন্ধান করণ ও তাদের পুনর্বাসনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় পাহাড়ের ভুমিকা অপরিসীম এবং পাহাড় রক্ষার্থে পাহাড়ের ঢাল রক্ষাকারী পরিবেশ ও পাহাড় বান্ধব বিভিন্ন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।

 

২.১ গভর্নেন্স সংক্রান্তঃ

 (১) পাহাড়ী এলাকায় পাহাড়ের মালিকানা নির্ধারণ করে প্রতিটি পাহাড়ের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার দায়িত্ব তৎসংলগ্ন মালিকের নিকট হস্তান্তর করা যেতে পারে। এর সাথে পাহাড়ের যে কোন ঘটনা বা পরিস্থিতিতে সে মালিক দায়বদ্ধ থাকবেন। উক্ত কাজ ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা পযায়ের স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে সমন্বয় করা।

 ২) প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশের ভারসাম্য ব্যহত হচ্ছে বিধায় পার্বত্য জেলা গুলোতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় স্থাপন করা; সমাজভিত্তিক পাহাড়, বনায়ন এবং পরিবেশ রক্ষা কর্মসূচি চালু করা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় দফতরের প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সমন্বয়ে মনিটরিং করা। উভয় ক্ষেত্রে কাজ এবং দায়-দায়িত্বের সুনির্দষ্ট টিওআর প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

 ৩) দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূমিধস প্রবন স্থানের বিশেষ করে পাহাড়গুলোর অবস্থা, অবস্থান, প্রকৃতি, প্রেক্ষাপট, পাহাড়ের ভূমি ব্যবহার ইত্যাদি ভিন্ন বিধায় সকল পাহাড় রক্ষাকল্পে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা। উক্ত নীতিমালার আলোকে দুর্যোগ ঝুঁকি অবহিত এবং দুর্যোগ সহনশীল ও পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পাহাড়ে যে কোন উন্নয়ন কাজের পূবে সি আর এ/ উআরএ (যে ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য) সম্পন্ন করা এবং তদনুযায়ী উন্নয়ন কাজের পরিকল্পনা করা। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে (বৃহদাকার ও সমন্বিত প্রকল্প) ডিআইএ সম্পন্ন করা।

 

২.২ ভূমি ব্যবহার সংক্রান্তঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধস ও পাহাড়ী ঢলের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসলীলার জন্য সেখানকার ভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এ দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসে নিম্নোক্ত এ প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিতে হবে যা সহায়করূপে বিবেচিত হতে হবে।

(১). ভুমিধস প্রবন এলাকা এবং পাহাড় সমূহের ধারণক্ষমতা ও আবাসের সক্ষমতা অনুসারে পাহাড়ের শ্রেণীবিভাগ করা। অথবা পাহাড় সমুহকে নানাবিধ দুর্যোগের ভিত্তিতে ভূমি বিভাগিকরণ (multi hazard land zonation) করা যেতে পারে এবং সেই সাথে একটি ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। [

 (২). ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমিধস প্রবন এলাকা এবং পাহাড় এর শ্রেণী পরিবর্তনের সকল আবেদন খারিজ করা এবং পরবর্তী জরিপের সময় যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে এ সকল ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমিধস প্রবন এলাকা এবং পাহাড়সমূহ সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করা;

(৩). ১ নং খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত পাহাড়, টিলা শ্রেণীর ভূমিতে ইতোপূর্বে স্থাপিত আশ্রায়ন, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প স্থানান্তর করা;

 ৪). ১ নং খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত পাহাড়, টিলা শ্রেণীর ভূমিতে ইতোপূর্বে যেসব বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে সেগুলি চিহ্নিত করে বাতিল করা;

 (৫). পাহাড় থেকে মাটি কর্তন বন্ধ করার জন্য ইটভাটাসমূহ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা;

 (৬). সামাজিক বনায়ন বিধিমালা-২০০৪ অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানাধীন, দখলকৃত ও স্বায়ত্তাধীন ভূমি, সংবিধিবদ্ধ সংস্থার ক্রয়কৃত ভূমি ও সরকারী ভূমিতে অংশীদারিত্বমূলক বনায়ন কার্যক্রম বনবিভাগ কর্তৃক অনতিবিলম্বে গ্রহণ করা আবশ্যক;

 (৭). অনতিবিলম্বে অবৈধ পাহাড় কর্তন বন্ধ হওয়া উচিত। এ প্রেক্ষিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা এবং জেলা প্রশাসন কর্তৃক নিয়মিত এ কার্যক্রম মনিটর করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থার দ্রুত প্রণয়ন এবং যথার্থ বিভাগ সমুহের দ্বারা তার তদারকি ও বাস্তবায়ন করা আবশ্যক।

 (৮). দুর্যোগের ফলে পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনে এবং পার্বত্যএলাকার সার্বিক পানির নিষ্কাশনে, পাহাড় উপযোগী নতুন পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণ এবং ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার আশু সংস্কার সাধন প্রয়োজন। বিশেষতঃ প্রয়োজনে সড়ক ও বাসস্থান সংযুক্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার দ্রুত সংস্কার ও উন্নয়ন সাধন।

 (৯). পাহাড়ে অধিক পরিমাণে পরিবেশ বান্ধব এবং রক্ষকারী বৃক্ষ রোপন যথা নানা জাতের বাঁশ, যেমন-মুলী, মিতিঙ্গা রোপন করে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে অড়হর, বাবলছে, মেডুলা ও ঢোলকলমী গাছ রোপন করা যেতে পারে। (১১), সুষ্ঠু পাহাড় ব্যবস্থাপনার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের (যথা- ভারত, নেপাল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন) এর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে 'জাতীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা' প্রণয়ন করা যেতে পারে

(১২). পাহাড়ের ঢাল রক্ষার্থে দ্রুত পরিবেশ বান্ধব বৃক্ষরোপণ করা, পাহাড়ের ঢাল রক্ষা ও ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত; উন্নতদেশসমূহে (যেমন: জাপান) পরীক্ষিত এবং বহুল ব্যবহৃত পাহাড় এবং ঢাল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি/জ্ঞান বিনিময়ের উদ্যোগ গ্রহণ। এ ধরণের প্রযুক্তি/জ্ঞানের ব্যবহার বিদ্যমান আনিী কাঠামোর আওতায় (যেমন: বিএনবিসি) বাধ্যতামূলক করা।

 (১৩). পাহাড় কাটার কুফল সম্পর্কে পাহাড়ী এলাকার জনগণকে সচেতন করা এবং এক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন।

(১৪). কাপ্তাই বাঁধ প্রশাসনের জবাব দিহিতা, নিয়মিত পানি প্রবাহ এবং পানির পরিমানের তথ্যের হালনাগাদ ও তথ্যের সময়মত সংশ্লিষ্ট মহলে অবহিতকরন আবশ্যক; হ্রদের নাব্য রক্ষায় নিয়মিত ড্রেজিং করা।

 

২.৩ দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস সংক্রান্তঃ

ভৌগলিক এবং ভূতাত্ত্বিক কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক ভাবে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ন একটি অঞ্চল। তার সাথে যুক্ত রয়েছে মনুষ্য কার্যকলাপ যা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে করে তুলেছে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ। এ দুর্যোগ ঝুঁকিহাসে নিম্নোক্ত নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে-

(১). ভূমিধ্বস বা পাহাড়ধ্বস সহ সকল দুর্যোগের পূর্বাভাস নিরোপন এবং তার সময় মত নিয়োজিত সকল বিভাগ এবং প্রশাসনকে অবহিতকরন এবং বিশেষ করে স্থানীয় জনতাকে সময় মত অবহিতকরনের  ওতারপর্যন্ত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা উচিৎ। সহজলভ্য প্রযুক্তি উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে এ সকল কাজে জনঅংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।

(২). দুর্যোগ ঝুঁকিমোকাবিলায় যথাযথ বিভাগের পর্যাপ্ত নিয়মিত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা রাখা;

(৩). খোঁজ এবং উদ্ধার কার্যে পর্যাপ্ত এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি/ মজুত রাখা;

(৪). স্বেচ্ছাসেবী দুর্যোগ কর্মী গড়ে তোলা এবং তাদের অংশগ্রহণের প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রাখা;

(৫). জরুরি অবস্থায় Coordination of private sector resources in the event of the emergencies.

(৬). প্রাথমিক চিকিৎসার ট্রেনিং এর ব্যবস্থা রাখা

(৭). ভূমিধস বা পাহাড়ধস মনিটরিং এবং ওয়ার্নিং সিস্টেম, Debris flow ওয়ার্নিং সিস্টেম এর ব্যবস্থা চালু করা উচিৎ;

(৮). চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা "Land Management for disaster" Apps তৈরী করা যাতে ভারী বর্ষনের পূর্বে সবার মোবাইলে একটি সমন্বিত message স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যেতে পারে।

 (১০). সড়ক ও জনপদের জন্য কিছু অতীব জরুরী প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও যানবাহন ক্রয় এবং রাঙামাটিতে সংরক্ষন করা যেমন Excavator, Dump truck, paywader, gradder, chain, Dodger, Roller, Racker Bulldodyer.

 (১১). চট্টগ্রাম রাঙামাটি মহাসড়বে hill side এবং valley side-এর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ স্থানসমূহেকে most vulnerable palce হিসাবে চিহ্নিত করে উক্ত স্থানে যেকোন ধরনের স্থাপনা, খনন, উন্নয়ন, পরিবর্তন আপাতত: রহিত করা।

(১২). রাঙামাটিতে দুর্যোগকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা চলমান রাখতে fuel Reservoir, water purification plant, generator ইত্যাদি সরঞ্জাম জরুরী অবস্থাকালীন সময়ের জন্য সংরক্ষন করা।

 (১৩). রাঙামাটি চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুইপাশের পাহাড় গুলোতে যে কোন ধরনের নতুন স্থাপনা তৈরীর অনুমতি সম্পূর্ন ভাবে রহিত করা এবং বর্তমান স্থাপনাসমূহ পর্যায়ক্রমে নিরাপদ ও দূরবর্তী স্থানে পূনর্বাসন করা।

 (১৪). সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ের slope সমূহ (রাস্তার পার্শ্বে) জরুরী ভিত্তিতে বনায়ন করে আগামী বর্ষার আগেই রক্ষা করতে হবে।

 (১৫). পাহাড়ী এলাকা থেকে সকল ইটের ভাটা অন্যত্র সরানো বা বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

 ২.৪ দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্তঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে দরিদ্রতার হার ৩১.৫% এবং অতি দরিদ্রতার হার ১৭.৬% এবং বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১.৪৭। এরুপ আর্থনৈরাব পশ্চাৎপদ অবস্থায় ভূমিধস ও পাহাড়ী ঢলের ন্যায় দুর্যোগে দরিদ্র জনজীবনে দরিদ্রতা আরও অতিরিক্ত ঘনীভূত ও জটিলাকার ধারণ করে। এ প্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে-

 

 ১. খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ একটি লাভজনক উপার্জনের উপায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ফল, সব্জি, ফসলসহ অন্যান্য আবাদের যথেষ্ট ফলন হচ্ছে। এ সকল আবাদের বা খাদ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় লাভজনক উপার্জনের উপায় সৃষ্টি করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে দায়িত্বশীল (রেসপন্সিবল) কৃষি ভ্যালু চেন গড়ে তোলা। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, পুঁজি ও পার্টনারশীপ সহায়তা প্রদান।

 ২. পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধসের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের বিশেষ ভাবে অতি দরিদ্র অসহায় নারীদের অবস্থার উন্নতির জন্য হাস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল-শুকর পালনে ও লাভজনক কৃষি কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানকরা যেতে পারে।

 ৩. সমাজভিত্তিক পর্যটন কার্যক্রম গড়ে তোলা। এ জন্য প্রশিক্ষণ ও পুঁজি সহায়তা প্রদান করা।

 

উপসংহারঃ

দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য ভূমিধস প্রবন এলাকাসমূহকে একটি পূর্ণাঙ্গ জনপদ হিসাবে টিকিয়ে রাখতে সুপরিকল্পিত পুনঃনির্মাণ (Re-construction)/ মহা পরিকল্পনা (মাস্টার প্ল্যান) প্রণয়ন এবং এ পরিকল্পনা নিয়ে যথাযথ অর্থায়ন নিশ্চিত করে কাজ শুরু করতে হবে। দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ দ্বারা গবেষনা করে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পুনর্গঠন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

 

সূত্রঃ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর